সেবায় দেরি মানে চাকরির অসদাচরণ

   সেবায় দেরি মানে চাকরির অসদাচরণ



এক দরজায় সব সেবা বা ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করেও বিনিয়োগকারীদের কম সময়ে সেবা দিতে ব্যর্থ সরকার অবশেষে এ–সংক্রান্ত একটি আইন করতে যাচ্ছে। ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস অ্যাক্ট’ নামের আইনটির খসড়ায় বলা হয়েছে, নির্ধারিত সময়ে বিনিয়োগকারীদের সেবা দিতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো ব্যর্থ হলে তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ক্ষেত্রে চাকরির অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে।

এই আইনের সঙ্গে সরকার চারটি সংস্থার জন্য চারটি বিধিমালাও তৈরি করছে। এসব বিধিমালায় বিদ্যুৎ ও গ্যাস–সংযোগ, ব্যবসা শুরু–সংক্রান্ত নিবন্ধন, ভবনের অবকাঠামোর নকশা ও অন্যান্য অনুমোদন, ভূমি নিবন্ধন, নামজারি ইত্যাদি সেবা কত দিনে দিতে হবে, তা ঠিক করে দেওয়া হবে। ওয়ান স্টপ সার্ভিস আইনটি জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনের পরে পাস হতে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)।

এসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বিশ্বব্যাংকের সহজে ব্যবসা করার সূচক বা ডুইং বিজনেসে বাংলাদেশের অবস্থানে উন্নতি আনার জন্য। বর্তমানে সহজে ব্যবসার দিক দিয়ে ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৬তম। এর মানে এ দেশে ব্যবসা করা বিনিয়োগকারীদের জন্য খুব কঠিন। অবশ্য নবগঠিত সংস্থা বিডা ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে এ সূচকে ১০০তম অবস্থানের নিচে আনার লক্ষ্য ঠিক করেছে।

ডুইং বিজনেস সূচকটি ১০টি মোটা দাগের বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। এগুলো হলো ব্যবসা শুরুর সময়, নির্মাণকাজের অনুমতি পাওয়া, বিদ্যুৎ–সংযোগ পাওয়া, জমির নিবন্ধন, ঋণ পাওয়া, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা, কর দেওয়া, বৈদেশিক বাণিজ্য, চুক্তির বাস্তবায়ন ও ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়া। বাংলাদেশ এসব ক্ষেত্রে সহজে সেবা দেওয়ার দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে, যা উন্নতির জন্যই এখন কাজ করছে বিডা।

সংস্থাটির পরিচালক তৌহিদুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, ইতিমধ্যে কিছু কিছু সেবা দ্রুত দেওয়া শুরু হয়েছে। তবে এসব সেবা দেওয়ার প্রক্রিয়া পুরো অনলাইনের মাধ্যমে পরিচালিত হবে ২০১৮ সাল থেকে। এর আগে ছয় মাস কিছুটা অনলাইন ও কিছুটা প্রচলিত পদ্ধতিতে (ম্যানুয়াল) পরিচালিত হবে।

এসব অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় করতে অর্থায়নে রাজি হয়েছে বিশ্বব্যাংক। তবে তারা কত টাকা দেবে, তা এখনো প্রকাশ করেনি বিডা।
বাংলাদেশে সহজে ব্যবসা করার জন্য এক দরজায় সব সেবা দেওয়ার দাবিটি অনেক পুরোনো এবং অনেক দিন ধরেই ওয়ান স্টপ সার্ভিস ছিল বিলুপ্ত হওয়া বিনিয়োগ বোর্ডে। তবে সেখানে গেলে বিনিয়োগকারীরা কার্যত কোনো সেবাই পেতেন না। ব্যবসায়ীরা একে বলতেন ‘ফুল স্টপ সার্ভিস’। এ নিয়ে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘বিগত ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে আমরা ওয়ান স্টপ সার্ভিস দেওয়ার কথা বলছি। কিন্তু কখনোই এ দেশে ওয়ান স্টপ সার্ভিস ছিল না।’
এই অবস্থার কারণেই সরকার সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে সময়মতো সেবা দিতে বাধ্য করতে ওয়ান স্টপ সার্ভিস আইন করার উদ্যোগ নেয়। বিডা জানিয়েছে, নতুন প্রক্রিয়ায় একজন বিনিয়োগ ঘরে বসেই অনলাইনে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টারে ২৫টি সেবার জন্য আবেদন করবেন। তাতে সংস্থায়, সংস্থায় দৌড়াতে হবে না। আইনের অধীনে বিডা, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) ও বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের (বিএইচটিপিএ) জন্য আলাদা তিনটি বিধি হচ্ছে। এসব বিধিতে উল্লেখ থাকবে কোন সংস্থা কত দিনে সেবা দেবে।
বিডা এখন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে বিভিন্ন সেবার ক্ষেত্রে একটি সময়সীমা ঠিক করেছে। যেমন ‘বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস রিপোর্ট-২০১৭’ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করার প্রাথমিক সেবাগুলো (ট্রেড লাইসেন্স, যৌথ মূলধনি কোম্পানির নিবন্ধন, সিল-প্যাড তৈরি, ব্যাংক হিসাব খোলা, টিআইএন ও মূল্য সংযোজন কর বা মূসক নিবন্ধনসহ ৯টি কাজ) শেষ করতে ১৯ দশমিক ৫ দিন সময় লাগে। বিডা বলছে, এ ক্ষেত্রে সময় কমিয়ে ৭ দিনে নিয়ে আসা হবে। বিদ্যুতের সংযোগ পেতে বর্তমানে ৪২৮ দিন লাগে, তা দিতে হবে ২৮ দিনে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বা এ ধরনের সংস্থার অধীনে থাকা সব প্রক্রিয়া শেষ করতে এখন ২৭৮ দিন লাগে, তা কমিয়ে ৬০ দিনে আনা হবে। জমির নিবন্ধন ও নামজারির প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় লাগে ২৪৪ দিন, যা দুদিনে শেষ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জমি নিবন্ধনে ১ দিন ও নামজারিতে ১ দিন সময় পাবে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। এদিকে বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তিতে হাইকোর্টে আলাদা বেঞ্চ গঠন ও জেলা পর্যায়ে সপ্তাহে অন্তত এক দিন এ ধরনের মামলা শুনানির ব্যবস্থা করতে বিচার বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করছে বিডা। সহজে ব্যবসা-সংক্রান্ত অন্যান্য ক্ষেত্রেও উন্নতির জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে বিডা, যা এপ্রিলে বিডার বোর্ড সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপিত হবে। বিডার চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগ গত ২০ ফেব্রুয়ারি একটি পরিপত্র জারি করেছে। এতে উচ্চ ক্ষমতার বৈদ্যুতিক সংযোগ ২৮ দিনে এবং আবাসিক সংযোগ ৭ দিনের মধ্যে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে। উচ্চ চাপের সংযোগের ক্ষেত্রে এখন থেকে আবেদন প্রাপ্তির ৫ দিনের মধ্যে কারিগরি তদন্ত ও জরিপ শেষ করতে হবে, পরবর্তী ১০ দিনে লোড বরাদ্দ করতে হবে। ডিমান্ড নোট ইস্যু করার জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা ২ দিন ও টাকা জমার জন্য গ্রাহক ৪ দিন সময় পাবেন। টাকা জমার পরবর্তী ৭ দিনের মধ্যে মিটার সরবরাহ করে বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়া হবে।
বিডার পরিচালক তৌহিদুর রহমান বলেন, এসব সেবা দেওয়ার যে সময়সীমা ঠিক করা হয়েছে, তা আরও কমতে পারে। পাশাপাশি তা সংস্থা ভেদে ভিন্ন হতে পারে। যেমন বেজার ক্ষেত্রে গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া সহজ। কারণ তাদের একটি অঞ্চলের মধ্যে শিল্প হবে। তবে বিডার ক্ষেত্রে শিল্প হবে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে। সে ক্ষেত্রে বিডার বেজার চেয়ে একটু বেশি সময় লাগতে পারে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে দ্রুত বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়া শুরু হয়েছে। সম্প্রতি এক বৈঠকে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ১০ দিনের মধ্যেও বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন।
আবেদন নিষ্পত্তি করতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোতে চারটি কমিটি থাকবে। ফোকাল পয়েন্ট কমিটিতে আবেদন যাবে। টাস্কফোর্স কর্মসম্পাদন কমিটি সেগুলো যাচাই-বাছাই করবে। কো-অর্ডিনেশন বা সমন্বয় কমিটি সমন্বয় করবে। ফাইনাল অ্যাসুরেন্স কমিটি চূড়ান্তভাবে আবেদন নিষ্পত্তি করবে।

Comments

Popular posts from this blog

হস্তমৈথুনের ফলে কতো ক্যালোরী খরচ হয় ?