সাক্ষাৎকার : হাসান আজিজুল হক ‘আমি আমার শেষ নিয়ে ভাবছি না’
- Get link
- X
- Other Apps
সাক্ষাৎকার : হাসান আজিজুল হক
‘আমি আমার শেষ নিয়ে ভাবছি না’
নতুন উপন্যাস নিয়ে ভাবছেন হাসান আজিজুল হক। করছেন অনুবাদও। সম্প্রতি হুুমায়ূন আহমেদের নামে প্রবর্তিত একটি পুরস্কার গ্রহণ করেছেন। এ নিয়ে সাহিত্যাঙ্গনে আছে নানা জল্পনা। কেন এত দিন স্মৃতিকথা লিখেছিলেন তিনি? বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি এ লেখক এবার স্পষ্ট উত্তর দিয়েছেন নানা প্রশ্নের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইসমাইল সাদী
ইসমাইল সাদী: আপনার বক্তৃতা অনেক সরস, শুনে সবাই আনন্দ পায়। কিন্তু আপনার লেখা পড়লে, বিশেষ করে গল্প পড়লে মনে হয়, আপনার ভেতরে একধরনের দুঃখবোধ সজাগ থাকে। ব্যক্তি হাসান আজিজুল হক লেখক হাসান আজিজুল হককে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
হাসান আজিজুল হক: হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ। সমাজের একজন মানুষ হিসেবে আমি প্রফুল্ল চিত্তের মানুষ। তাই ইচ্ছা করে মানুষের সামনে আমি দুঃখবিলাস করি না। অপ্রাপ্তির কোনো বালাই নেই আমার মধ্যে। এক অর্থে বলতে পারো, সমাজের একজন মানুষ হিসেবে আমি সন্তুষ্ট। কিন্তু গভীর অনেক দুঃখের ব্যাপার তো আমার মনের মধ্যে আছে; তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেগুলো যে আমাকে কখনো কখনো ভারাক্রান্ত করে না, তা নয়। তবু সামাজিক জীবনে মানুষ আমাকে সদা হাসিখুশি, প্রফুল্ল দেখতে পায়। কারণ, কথা বলা আর বক্তৃতা করার মধ্যে আমি কোনো পার্থক্য করি না। কিন্তু গুছিয়ে যখন লিখতে যাই, তখন অতলের ভেতর থেকে অনেক জিনিস উঠে আসে। গল্প লিখতে গেলেও সেটা হয়। তবে লক্ষ করবে, তাই বলে কোথাও আমি অশ্রুপাত করি না। যত কষ্টের গল্প লিখি না কেন, যত যা-ই লিখি না কেন, তা নিরশ্রু। জীবনের মূল চেহারাটা আমি দেখি বলেই নিস্পৃহ থাকি। সামাজিক জীবনে, পারিবারিক জীবনে যতটুকু পারি, আমি সবটুকু নিংড়ে নিই জীবন থেকে। কেউ যদি বলে, আপনার দুঃখ নেই? আমি তাকে অনেক গভীর দুঃখের কথা বলতে পারব, তাতে সন্দেহ নেই।
সাদী: অর্থাৎ, আপনার ব্যক্তিসত্তা আর লেখকসত্তার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে?
হাসান: হ্যাঁ, কিছুটা পার্থক্য আছে। তোমরা স্পষ্ট চোখে যেটা দেখো, সেটা অনেকটা ঠিক।
সাদী: ইদানীং আপনি স্মৃতিগদ্য, স্মৃতিকথা বেশি লিখছেন। বহুদিন থেকে পাঠক আপনার কাছ থেকে নতুন গল্প পাচ্ছে না। অনেকেই আলোচনা করেন, গল্প-উপন্যাস বাদ দিয়ে স্মৃতিকথা কেন লিখছেন হাসান আজিজুল হক? সাধারণত স্মৃতিকথা তো লেখকেরা শেষ জীবনে লেখেন। তার মানে হাসান আজিজুল হকের বলার কথা কি শেষ?
হাসান: যাঁরা এমন মনে করেন তাঁদের জন্য বলছি, আমি আমার শেষ নিয়ে ভাবছি না। শেষ হয়ে যাওয়াটা আমার ভাবনার মধ্যে নেই। আমার মনে হয়েছিল, স্মৃতিকথাটা হচ্ছে আমার ব্যক্তিত্বের, আমার মানুষ হয়ে ওঠার আকর; সেটা সবাইকে জানানো দরকার। আমি সেটা লিখে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছি, উপভোগ করেছি। আর সহজে আমি স্মৃতিকথা লিখব না। তবে গল্প, উপন্যাস লিখব কি না...হ্যাঁ, গল্প লিখতেও পারি। আমার পাঠকেরা আরও অনেক কিছু মনে করতে পারেন। সেটা নিয়ে আমার আর কিছু বলার নেই।
সাদী: হঠাৎ আর্নেস্ট হেমিংওয়ের লেখা অনুবাদ করতে শুরু করলেন...।
হাসান: হেমিংওয়ে আমার প্রিয় লেখকদের একজন। তাঁর লেখা প্রথম পড়েছি ১৯৫৮ সালে—আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস। তখন আমি গ্র্যাজুয়েশন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। অনেক দিন আগে প্রথম আলোতেই একটি গল্প অনুবাদ করেছিলাম ‘ব্রিজের ধারে একটি বৃদ্ধ’ নামে। মূল গল্পের নাম ‘দ্য ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য ব্রিজ’। হেমিংওয়েকে লোকে গ্রেট লেখক বলে না, গ্রেট নোভেলিস্টও বলে না। তাঁর বলার ভঙ্গি আকর্ষণীয় আমার কাছে। খটখট করে বলে যাওয়া—বিশেষণবর্জিত গদ্য—স্টেটমেন্টের মতো করে গদ্য লেখেন। বিশেষণ ব্যবহার করতেই চান না। এটা আমাকে টানে।
মৃত্যু, জরা প্রভৃতি হেমিংওয়ের লেখার বিষয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্বব্যাপী সংঘটিত ধ্বংসলীলা তিনি দেখেছেন। ওই সময় ইউরোপ টুকরোটাকরা হয়ে গিয়েছিল। এসব অঞ্চলের মানুষের মধ্যে মানবিক পতন দেখেছেন। দেখেছেন, মানুষের সুকুমারবৃত্তিগুলো প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তার প্রতীকী বর্ণনা ছিল এ রকম: মানুষের পুরুষত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেছেন, মানুষের মেরুদণ্ড থেকে শিশ্ন পর্যন্ত ভেঙে পড়েছে। বলতে পারো, হেমিংওয়ে আমার খুব ভালো করে পড়া আছে। সে কারণেই অনুবাদের মাধ্যমে পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করার চেষ্টা করছি। সামনে দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি অনুবাদ করব। তবে তাঁর এত সুন্দর ইংরেজি থেকে দুই পৃষ্ঠা অনুবাদ করার পর যদি মনে হয়, মানটা সেটার মতো হচ্ছে না, তাহলে ছিঁড়ে ফেলে দেব; করব না।
সাদী: কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, একটা উপন্যাস লিখছেন। সেটা কবে নাগাদ পাঠক হাতে পেতে পারে?
হাসান: ওটা আর খুব বেশি দূর এগোয়নি। মাঝখানে স্মৃতিগদ্যসহ আরও কিছু বিষয়ে লিখতে গিয়ে ওটা আর ধরতে পারিনি। সেই উপন্যাস আবার ধরতে পারি কি না, সেটা দেখছি। সেটা প্রায় ১০০ পৃষ্ঠার মতো হয়ে আছে। কিন্তু আমার পরিকল্পনা ছিল, ওটা ৪০০-৫০০ পৃষ্ঠা লিখব। পরিকল্পনাটা এখনো আছে। তবে অত বড় আর করা যাবে না। পাকিস্তান আমলের একটা বিশেষ ঘটনা এর পটভূমি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকার এক সাধারণ লোক কিছু জমির মালিক ছিল; বিঘা দশেক জমি ছিল তাদের। সে মূলত চানাচুর-বাদাম বিক্রি করে সংসার চালাত। প্রতিপক্ষরা সেই লোককে এক দিন ধরে নিয়ে মেরে টুকরো টুকরো করে লাশ নিশ্চিহ্ন করে দেয়। তবু তারা দেখল, জমি তো নিষ্কণ্টক হলো না। কারণ, সেই লোকের বউ এবং পাঁচজন ছেলেমেয়ে বেঁচে রয়েছে। তারা এক দিন গিয়ে ওই লোকের বউসহ পাঁচ ছেলেমেয়েকেও খুন করে টুকরো টুকরো করে চুন দিয়ে ড্রামে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। পরে সেটা আবিষ্কৃত হয়। এটা ওই সময় সাংঘাতিক আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটা ঘটনা ছিল। শেষ পর্যন্ত আনন্দের কথা হলো, এই ঘটনার মূল যে ছিল—তাজুল ইসলাম—তার ফাঁসি হয়েছিল। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু নির্যাতন, লোভী মানুষের দম্ভ প্রভৃতি সামাজিক বাস্তবতা নিয়ে ওই উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা করেছিলাম।
এ ছাড়া ঢাকার শ্রীবৃদ্ধি করে কী করা হচ্ছে, এটা নিয়ে মোটামুটি একটা উপন্যাস লিখব। ছোবল নামে উপন্যাসের মতো এবারের বইমেলায় যে বইটা বেরিয়েছে, সেটা একেবারে ছোট্ট। সেখানে দেখানো হয়েছে শহর ক্রমশ ছুবলে ছুবলে গ্রামকে দখল করছে। বলতে পারো, এটাকে প্লট হিসেবে ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমি আশাও করেছিলাম, আমার চেয়ে যোগ্য বা দক্ষ কেউ এটাকে নিয়ে বড় উপন্যাসের পরিকল্পনা করুক, লিখুক। কিন্তু কেউ লিখল না। এটা নিয়ে এখনো কেউ লিখতে পারে, ভাবতে পারে। আমার এখন মনে হচ্ছে, ছোবলটা যখন বেরোল, তখন ওটাতে আরও কিছু ইঙ্গিত-সংকেত যোগ করে ওটাকে আরেকটু বড় করব।
সাদী: কিন্তু সংখ্যালঘু ও লোভী মানুষের বাস্তবতায় পরিকল্পিত উপন্যাসটা ছোট করার চিন্তা করছেন কেন? বাস্তবতাটা তো এখনো বাংলাদেশের সমাজে বিরাজমান।
হাসান: কারণ, প্রেক্ষাপটটা বদলে যাচ্ছে। পাকিস্তান আমলে যেভাবে মেরে তাড়িয়ে দেওয়া হতো, এখন সেভাবে হচ্ছে না। তবে এখনো রয়েছে—নাসিরনগরের ঘটনা সেটার বড় দৃষ্টান্ত। হচ্ছে অন্যভাবে। ধরনটা বদলে গেছে।
সাদী: গল্প বলার একটা ঐতিহ্য আছে আমাদের, যেখান থেকে গল্প লেখারও একটা ঐতিহ্য তৈরি হয়েছিল। অবস্থাটা সে রকম আছে বলে মনে হয়? নব্বইয়ের দশকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রশ্ন তুলেছিলেন, বাংলা ছোটগল্প কি মরে যাচ্ছে? আপনি তখন বলেছিলেন, না, নতুন করে তৈরি হচ্ছে বাংলা ছোটগল্প। বর্তমান বাস্তবতাটা আসলে কেমন?
হাসান: ইলিয়াস যেটা বলেছিলেন, সেটা তো টুক করে বলেননি? এর সূত্র পেতে গেলে গোটা ইলিয়াসকে দেখতে হবে। এটাও দেখতে হয়, কী করে সাহিত্যে ব্যক্তির যাত্রা শুরু হলো—উপন্যাস শুরুর সঙ্গে সঙ্গে। একটা সময় পর্যন্ত কৃষিপ্রধান সমাজে কোনো ব্যক্তি ছিল না, পুঁজিপতি ছিল না—সামন্তপ্রধানকে কেন্দ্র করে গতিশীল ছিল সবকিছু। সেখান থেকে ব্যক্তি এল। তার মানে পুঁজিবাদের সঙ্গে ব্যক্তির উত্থান ঘটে। সামন্তবাদে কি ব্যক্তি পাওয়া যায়? না। আর ব্যক্তি যখন এল, প্রত্যেকেই একেকজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি, তাকে
মর্যাদা দিতে হবে। জমি থেকে মানুষকে টেনে আনার জন্যই এই মুক্তিটা দেওয়া হয়েছে। বলা হলো তুমি স্বাধীন। ইচ্ছা হলে কাজ করবে, না হলে করবে না। কিন্তু পুঁজিবাদী উৎপাদন যন্ত্রটা এমনভাবে তৈরি করা হলো, স্বাধীন হওয়ার পর সেই মানুষ তার শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য। শ্রম বিক্রি না করলে পেটে ভাত যাবে না। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে স্বতন্ত্র হতে পারে, কিন্তু সাধারণভাবে কথাটি ঠিক। সে জন্যই বাংলা গল্প মরা-বাঁচার প্রসঙ্গটি এসেছিল। অত সহজে কোনো কিছু মরে না; আমি বলেছিলাম গল্প থাকবে। আসলে গল্প নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এখন আর ওভাবে গল্প লেখা হচ্ছে না। আমাদের দুজনের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও বলতে হয়, বাস্তবতাটা প্রায় এক। এখন ওয়াসি আহমেদ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, জাকির তালুকদারের মতো কেউ গল্প লিখতে পারে না।
সাদী: গল্প নিয়ে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
হাসান: আমি ঠিক জানি না, যদি মনে করি, মানুষই প্রধান, সে যা করে, তা নিয়েই লিখতে হবে। তাকে দিয়ে কিছু করানো কঠিন। প্রযুক্তির বিস্তার ঘটেছে। আমরা তা থেকে এত এত সুবিধা নিচ্ছি, পড়ার অভ্যাসটাও নষ্ট করে ফেলছি। নিজেদের সৃজনশীল জায়গাটাকে আমরা নষ্ট করে ফেলছি। এত সময় ধরে যে ইন্টারনেটে বসবে, ফেসবুকে বসবে, তার আর ইচ্ছা বা সুযোগ থাকবে না পড়ার, চিন্তা করার বা লেখার। তার মানে হচ্ছে, সাধারণভাবে বর্তমান সমাজব্যবস্থাই সৃজনশীলতাকে অনেকখানি মেরে ফেলছে। তবে এর মধ্যেও আমি আশা হারাতে চাই না। আজ অবস্থাটা ভালো নয়, কাল ভালো হবে না, এ কথা তো জোর দিয়ে বলা যাবে না। লেখক নিশ্চয় উঠে আসবে। এখনো তো শাহীন আখতার লিখে যাচ্ছে, জাকির তালুকদার লিখে যাচ্ছে, সেটাও ভালো লক্ষণ।
সাদী: বিশ্বসাহিত্যের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে, মাঝেমধ্যে সাহিত্যের সীমানা নির্দিষ্ট থাকছে না। এবার তো নোবেল পুরস্কার পেলেন বব ডিলান। ফিকশন, নন-ফিকশন একাকার হয়ে গেল কি না?
হাসান: তোমাকেই প্রশ্ন করি, নোবেল পুরস্কারের উদাহরণটা আমরা হুট করে দিই কেন? সেটাই কি পৃথিবীতে একমাত্র মানদণ্ড? পৃথিবীতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বহু লেখক তুচ্ছ লেখক। আবার নোবেল পেতে পারতেন কিন্তু পাননি, এমন লেখক অসংখ্য। কাজেই নোবেল পুরস্কার পাওয়াটা ব্যাপার নয়। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রবর্তনে শুরুর দিকে নোবেল দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল টলস্টয়কে। তখন তাঁর বয়স প্রায় ৮০ বছর। তিনি বলেছিলেন, ‘দয়া করো; যাতে আমাকে লিখতে না হয়, আমি পুরস্কারটা নিলাম না। আমাকে দেওয়ার চেষ্টা কোরো না।’ বার্নার্ড শও ওই রকম। জ্যঁ পল সার্ত্রেও তা-ই। তাঁরা মনে করেছিলেন, পুরস্কার নিলে কোথায় যেন বাঁধা পড়ে যাব অর্থের কাছে, লেখার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হতে পারে। সে জন্যই বলছি, আজকে এই দায়বদ্ধতার জায়গাগুলো থেকে আমরা অনেকটা সরে গেছি। এই সরে যাওয়ার পেছনে প্রযুক্তি এবং অন্যান্য বিষয় আছে বলে মনে হয়। সে জন্যই তোমাদের কাছে মনে হচ্ছে, লেখাটা অধস্তন জায়গায় চলে গেছে।
আর ফিকশন, নন-ফিকশনের কথা বলছ? এটা নিয়ে আমি কখনো ভাবিইনি। এটা অনেকটা জল-বিভাজনের মতো। বিভাজন করলে আবার সঙ্গে সঙ্গে একাকার হয়ে যাবে। তাই এ ধরনের বিভাজন করা ঠিক নয়।
সাদী: ২০০২ সালের এক সাক্ষাৎকারে হহুতমায়ূন আহমেদ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, হুঁমায়ূন আহমেদ সাহিত্যের জন্য ভালো কিছু করছেন না। এমনকি তিনি বেঁচে থাকা অবস্থায় আপনি তাঁকে কখনো ধারণ করেছেন বলে মনে হয় না। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের নামে প্রবর্তিত পুরস্কারটি সম্প্রতি আপনি গ্রহণ করলেন এবং তাঁকে নিয়ে বেশ প্রশস্তিসূচক একটা লেখাও লিখলেন। আপনার পাঠকদের অনেকেই একে সহজভাবে নেননি।
হাসান: হু০মায়ূন আহমেদের ওপর এবার যেমন লিখেছি, অনেক আগেও লিখেছি। আর হুমায়ূনকে আমি গালিগালাজ করেছি বা অননুমোদন করেছি, দেখেছ কোনো দিন? তাঁর সঙ্গে আমার একেবারে অন্য রকম সম্পর্ক ছিল। তাই বলে কি আমি তাঁকে অনেক বড় লেখক বলব? তা বলব না। এখনো বলব না, তখনো বলিনি। আমি বলেছি, সে খুব জনপ্রিয় ছিল। তাতে তো অন্যায় কাজ কিছু করেনি! স্বীকার করতে হবে, জনপ্রিয়তা একজন লেখকের একটা মানদণ্ড। রবীন্দ্রনাথের ফিকশনের চেয়ে শরতের ফিকশন তো জনপ্রিয় ছিল। সেখানে কি বড়-ছোটর প্রশ্ন উঠেছে? কেউ কি বলতে পারবে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অবজ্ঞা করেছেন? এই জায়গাগুলো বুঝতে হবে।
হুতমায়ূনের সাহিত্য নিয়ে যে মত, হুকমায়ূনের নামে যে পুরস্কার—এ দুটো কিন্তু এক জিনিস নয়। ‘হুছমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’ আমি কেন গ্রহণ করব না? আমি মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার থেকে শুরু করে অনেকের পুরস্কারই তো নিয়েছি। সমালোচনা হলে অন্য পুরস্কারগুলোরও সমালোচনা হওয়া উচিত। আর হুমায়ূনের প্রতি তো আমার অশ্রদ্ধা ছিল না। লোকে ভুল মনে করছে। তাঁর সঙ্গে আমার খুব প্রীতির সম্পর্ক ছিল। একবার নিউইয়র্কে গিয়ে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। হুমায়ূনও তখন আমেরিকায় ছিল। আমার অসুস্থতার খবর পেয়ে সে হসপিটালে আমার বিছানার পাশে বসে ছিল। বলছিল, ‘স্যার, আপনি অসুস্থ শুনে আমি দেখতে এসেছি।’ হুমায়ূন তো মানুষ হিসেবে খুব ভালো ছিল।
সাদী: অর্থাৎ, আপনার ব্যক্তিসত্তা আর লেখকসত্তার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে?
হাসান: হ্যাঁ, কিছুটা পার্থক্য আছে। তোমরা স্পষ্ট চোখে যেটা দেখো, সেটা অনেকটা ঠিক।
সাদী: ইদানীং আপনি স্মৃতিগদ্য, স্মৃতিকথা বেশি লিখছেন। বহুদিন থেকে পাঠক আপনার কাছ থেকে নতুন গল্প পাচ্ছে না। অনেকেই আলোচনা করেন, গল্প-উপন্যাস বাদ দিয়ে স্মৃতিকথা কেন লিখছেন হাসান আজিজুল হক? সাধারণত স্মৃতিকথা তো লেখকেরা শেষ জীবনে লেখেন। তার মানে হাসান আজিজুল হকের বলার কথা কি শেষ?
হাসান: যাঁরা এমন মনে করেন তাঁদের জন্য বলছি, আমি আমার শেষ নিয়ে ভাবছি না। শেষ হয়ে যাওয়াটা আমার ভাবনার মধ্যে নেই। আমার মনে হয়েছিল, স্মৃতিকথাটা হচ্ছে আমার ব্যক্তিত্বের, আমার মানুষ হয়ে ওঠার আকর; সেটা সবাইকে জানানো দরকার। আমি সেটা লিখে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছি, উপভোগ করেছি। আর সহজে আমি স্মৃতিকথা লিখব না। তবে গল্প, উপন্যাস লিখব কি না...হ্যাঁ, গল্প লিখতেও পারি। আমার পাঠকেরা আরও অনেক কিছু মনে করতে পারেন। সেটা নিয়ে আমার আর কিছু বলার নেই।
সাদী: হঠাৎ আর্নেস্ট হেমিংওয়ের লেখা অনুবাদ করতে শুরু করলেন...।
হাসান: হেমিংওয়ে আমার প্রিয় লেখকদের একজন। তাঁর লেখা প্রথম পড়েছি ১৯৫৮ সালে—আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস। তখন আমি গ্র্যাজুয়েশন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। অনেক দিন আগে প্রথম আলোতেই একটি গল্প অনুবাদ করেছিলাম ‘ব্রিজের ধারে একটি বৃদ্ধ’ নামে। মূল গল্পের নাম ‘দ্য ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য ব্রিজ’। হেমিংওয়েকে লোকে গ্রেট লেখক বলে না, গ্রেট নোভেলিস্টও বলে না। তাঁর বলার ভঙ্গি আকর্ষণীয় আমার কাছে। খটখট করে বলে যাওয়া—বিশেষণবর্জিত গদ্য—স্টেটমেন্টের মতো করে গদ্য লেখেন। বিশেষণ ব্যবহার করতেই চান না। এটা আমাকে টানে।
মৃত্যু, জরা প্রভৃতি হেমিংওয়ের লেখার বিষয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্বব্যাপী সংঘটিত ধ্বংসলীলা তিনি দেখেছেন। ওই সময় ইউরোপ টুকরোটাকরা হয়ে গিয়েছিল। এসব অঞ্চলের মানুষের মধ্যে মানবিক পতন দেখেছেন। দেখেছেন, মানুষের সুকুমারবৃত্তিগুলো প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তার প্রতীকী বর্ণনা ছিল এ রকম: মানুষের পুরুষত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেছেন, মানুষের মেরুদণ্ড থেকে শিশ্ন পর্যন্ত ভেঙে পড়েছে। বলতে পারো, হেমিংওয়ে আমার খুব ভালো করে পড়া আছে। সে কারণেই অনুবাদের মাধ্যমে পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করার চেষ্টা করছি। সামনে দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি অনুবাদ করব। তবে তাঁর এত সুন্দর ইংরেজি থেকে দুই পৃষ্ঠা অনুবাদ করার পর যদি মনে হয়, মানটা সেটার মতো হচ্ছে না, তাহলে ছিঁড়ে ফেলে দেব; করব না।
সাদী: কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, একটা উপন্যাস লিখছেন। সেটা কবে নাগাদ পাঠক হাতে পেতে পারে?
হাসান: ওটা আর খুব বেশি দূর এগোয়নি। মাঝখানে স্মৃতিগদ্যসহ আরও কিছু বিষয়ে লিখতে গিয়ে ওটা আর ধরতে পারিনি। সেই উপন্যাস আবার ধরতে পারি কি না, সেটা দেখছি। সেটা প্রায় ১০০ পৃষ্ঠার মতো হয়ে আছে। কিন্তু আমার পরিকল্পনা ছিল, ওটা ৪০০-৫০০ পৃষ্ঠা লিখব। পরিকল্পনাটা এখনো আছে। তবে অত বড় আর করা যাবে না। পাকিস্তান আমলের একটা বিশেষ ঘটনা এর পটভূমি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকার এক সাধারণ লোক কিছু জমির মালিক ছিল; বিঘা দশেক জমি ছিল তাদের। সে মূলত চানাচুর-বাদাম বিক্রি করে সংসার চালাত। প্রতিপক্ষরা সেই লোককে এক দিন ধরে নিয়ে মেরে টুকরো টুকরো করে লাশ নিশ্চিহ্ন করে দেয়। তবু তারা দেখল, জমি তো নিষ্কণ্টক হলো না। কারণ, সেই লোকের বউ এবং পাঁচজন ছেলেমেয়ে বেঁচে রয়েছে। তারা এক দিন গিয়ে ওই লোকের বউসহ পাঁচ ছেলেমেয়েকেও খুন করে টুকরো টুকরো করে চুন দিয়ে ড্রামে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। পরে সেটা আবিষ্কৃত হয়। এটা ওই সময় সাংঘাতিক আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটা ঘটনা ছিল। শেষ পর্যন্ত আনন্দের কথা হলো, এই ঘটনার মূল যে ছিল—তাজুল ইসলাম—তার ফাঁসি হয়েছিল। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু নির্যাতন, লোভী মানুষের দম্ভ প্রভৃতি সামাজিক বাস্তবতা নিয়ে ওই উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা করেছিলাম।
এ ছাড়া ঢাকার শ্রীবৃদ্ধি করে কী করা হচ্ছে, এটা নিয়ে মোটামুটি একটা উপন্যাস লিখব। ছোবল নামে উপন্যাসের মতো এবারের বইমেলায় যে বইটা বেরিয়েছে, সেটা একেবারে ছোট্ট। সেখানে দেখানো হয়েছে শহর ক্রমশ ছুবলে ছুবলে গ্রামকে দখল করছে। বলতে পারো, এটাকে প্লট হিসেবে ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমি আশাও করেছিলাম, আমার চেয়ে যোগ্য বা দক্ষ কেউ এটাকে নিয়ে বড় উপন্যাসের পরিকল্পনা করুক, লিখুক। কিন্তু কেউ লিখল না। এটা নিয়ে এখনো কেউ লিখতে পারে, ভাবতে পারে। আমার এখন মনে হচ্ছে, ছোবলটা যখন বেরোল, তখন ওটাতে আরও কিছু ইঙ্গিত-সংকেত যোগ করে ওটাকে আরেকটু বড় করব।
সাদী: কিন্তু সংখ্যালঘু ও লোভী মানুষের বাস্তবতায় পরিকল্পিত উপন্যাসটা ছোট করার চিন্তা করছেন কেন? বাস্তবতাটা তো এখনো বাংলাদেশের সমাজে বিরাজমান।
হাসান: কারণ, প্রেক্ষাপটটা বদলে যাচ্ছে। পাকিস্তান আমলে যেভাবে মেরে তাড়িয়ে দেওয়া হতো, এখন সেভাবে হচ্ছে না। তবে এখনো রয়েছে—নাসিরনগরের ঘটনা সেটার বড় দৃষ্টান্ত। হচ্ছে অন্যভাবে। ধরনটা বদলে গেছে।
সাদী: গল্প বলার একটা ঐতিহ্য আছে আমাদের, যেখান থেকে গল্প লেখারও একটা ঐতিহ্য তৈরি হয়েছিল। অবস্থাটা সে রকম আছে বলে মনে হয়? নব্বইয়ের দশকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রশ্ন তুলেছিলেন, বাংলা ছোটগল্প কি মরে যাচ্ছে? আপনি তখন বলেছিলেন, না, নতুন করে তৈরি হচ্ছে বাংলা ছোটগল্প। বর্তমান বাস্তবতাটা আসলে কেমন?
হাসান: ইলিয়াস যেটা বলেছিলেন, সেটা তো টুক করে বলেননি? এর সূত্র পেতে গেলে গোটা ইলিয়াসকে দেখতে হবে। এটাও দেখতে হয়, কী করে সাহিত্যে ব্যক্তির যাত্রা শুরু হলো—উপন্যাস শুরুর সঙ্গে সঙ্গে। একটা সময় পর্যন্ত কৃষিপ্রধান সমাজে কোনো ব্যক্তি ছিল না, পুঁজিপতি ছিল না—সামন্তপ্রধানকে কেন্দ্র করে গতিশীল ছিল সবকিছু। সেখান থেকে ব্যক্তি এল। তার মানে পুঁজিবাদের সঙ্গে ব্যক্তির উত্থান ঘটে। সামন্তবাদে কি ব্যক্তি পাওয়া যায়? না। আর ব্যক্তি যখন এল, প্রত্যেকেই একেকজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি, তাকে
মর্যাদা দিতে হবে। জমি থেকে মানুষকে টেনে আনার জন্যই এই মুক্তিটা দেওয়া হয়েছে। বলা হলো তুমি স্বাধীন। ইচ্ছা হলে কাজ করবে, না হলে করবে না। কিন্তু পুঁজিবাদী উৎপাদন যন্ত্রটা এমনভাবে তৈরি করা হলো, স্বাধীন হওয়ার পর সেই মানুষ তার শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য। শ্রম বিক্রি না করলে পেটে ভাত যাবে না। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে স্বতন্ত্র হতে পারে, কিন্তু সাধারণভাবে কথাটি ঠিক। সে জন্যই বাংলা গল্প মরা-বাঁচার প্রসঙ্গটি এসেছিল। অত সহজে কোনো কিছু মরে না; আমি বলেছিলাম গল্প থাকবে। আসলে গল্প নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এখন আর ওভাবে গল্প লেখা হচ্ছে না। আমাদের দুজনের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও বলতে হয়, বাস্তবতাটা প্রায় এক। এখন ওয়াসি আহমেদ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, জাকির তালুকদারের মতো কেউ গল্প লিখতে পারে না।
সাদী: গল্প নিয়ে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
হাসান: আমি ঠিক জানি না, যদি মনে করি, মানুষই প্রধান, সে যা করে, তা নিয়েই লিখতে হবে। তাকে দিয়ে কিছু করানো কঠিন। প্রযুক্তির বিস্তার ঘটেছে। আমরা তা থেকে এত এত সুবিধা নিচ্ছি, পড়ার অভ্যাসটাও নষ্ট করে ফেলছি। নিজেদের সৃজনশীল জায়গাটাকে আমরা নষ্ট করে ফেলছি। এত সময় ধরে যে ইন্টারনেটে বসবে, ফেসবুকে বসবে, তার আর ইচ্ছা বা সুযোগ থাকবে না পড়ার, চিন্তা করার বা লেখার। তার মানে হচ্ছে, সাধারণভাবে বর্তমান সমাজব্যবস্থাই সৃজনশীলতাকে অনেকখানি মেরে ফেলছে। তবে এর মধ্যেও আমি আশা হারাতে চাই না। আজ অবস্থাটা ভালো নয়, কাল ভালো হবে না, এ কথা তো জোর দিয়ে বলা যাবে না। লেখক নিশ্চয় উঠে আসবে। এখনো তো শাহীন আখতার লিখে যাচ্ছে, জাকির তালুকদার লিখে যাচ্ছে, সেটাও ভালো লক্ষণ।
সাদী: বিশ্বসাহিত্যের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে, মাঝেমধ্যে সাহিত্যের সীমানা নির্দিষ্ট থাকছে না। এবার তো নোবেল পুরস্কার পেলেন বব ডিলান। ফিকশন, নন-ফিকশন একাকার হয়ে গেল কি না?
হাসান: তোমাকেই প্রশ্ন করি, নোবেল পুরস্কারের উদাহরণটা আমরা হুট করে দিই কেন? সেটাই কি পৃথিবীতে একমাত্র মানদণ্ড? পৃথিবীতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বহু লেখক তুচ্ছ লেখক। আবার নোবেল পেতে পারতেন কিন্তু পাননি, এমন লেখক অসংখ্য। কাজেই নোবেল পুরস্কার পাওয়াটা ব্যাপার নয়। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রবর্তনে শুরুর দিকে নোবেল দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল টলস্টয়কে। তখন তাঁর বয়স প্রায় ৮০ বছর। তিনি বলেছিলেন, ‘দয়া করো; যাতে আমাকে লিখতে না হয়, আমি পুরস্কারটা নিলাম না। আমাকে দেওয়ার চেষ্টা কোরো না।’ বার্নার্ড শও ওই রকম। জ্যঁ পল সার্ত্রেও তা-ই। তাঁরা মনে করেছিলেন, পুরস্কার নিলে কোথায় যেন বাঁধা পড়ে যাব অর্থের কাছে, লেখার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হতে পারে। সে জন্যই বলছি, আজকে এই দায়বদ্ধতার জায়গাগুলো থেকে আমরা অনেকটা সরে গেছি। এই সরে যাওয়ার পেছনে প্রযুক্তি এবং অন্যান্য বিষয় আছে বলে মনে হয়। সে জন্যই তোমাদের কাছে মনে হচ্ছে, লেখাটা অধস্তন জায়গায় চলে গেছে।
আর ফিকশন, নন-ফিকশনের কথা বলছ? এটা নিয়ে আমি কখনো ভাবিইনি। এটা অনেকটা জল-বিভাজনের মতো। বিভাজন করলে আবার সঙ্গে সঙ্গে একাকার হয়ে যাবে। তাই এ ধরনের বিভাজন করা ঠিক নয়।
সাদী: ২০০২ সালের এক সাক্ষাৎকারে হহুতমায়ূন আহমেদ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, হুঁমায়ূন আহমেদ সাহিত্যের জন্য ভালো কিছু করছেন না। এমনকি তিনি বেঁচে থাকা অবস্থায় আপনি তাঁকে কখনো ধারণ করেছেন বলে মনে হয় না। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের নামে প্রবর্তিত পুরস্কারটি সম্প্রতি আপনি গ্রহণ করলেন এবং তাঁকে নিয়ে বেশ প্রশস্তিসূচক একটা লেখাও লিখলেন। আপনার পাঠকদের অনেকেই একে সহজভাবে নেননি।
হাসান: হু০মায়ূন আহমেদের ওপর এবার যেমন লিখেছি, অনেক আগেও লিখেছি। আর হুমায়ূনকে আমি গালিগালাজ করেছি বা অননুমোদন করেছি, দেখেছ কোনো দিন? তাঁর সঙ্গে আমার একেবারে অন্য রকম সম্পর্ক ছিল। তাই বলে কি আমি তাঁকে অনেক বড় লেখক বলব? তা বলব না। এখনো বলব না, তখনো বলিনি। আমি বলেছি, সে খুব জনপ্রিয় ছিল। তাতে তো অন্যায় কাজ কিছু করেনি! স্বীকার করতে হবে, জনপ্রিয়তা একজন লেখকের একটা মানদণ্ড। রবীন্দ্রনাথের ফিকশনের চেয়ে শরতের ফিকশন তো জনপ্রিয় ছিল। সেখানে কি বড়-ছোটর প্রশ্ন উঠেছে? কেউ কি বলতে পারবে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অবজ্ঞা করেছেন? এই জায়গাগুলো বুঝতে হবে।
হুতমায়ূনের সাহিত্য নিয়ে যে মত, হুকমায়ূনের নামে যে পুরস্কার—এ দুটো কিন্তু এক জিনিস নয়। ‘হুছমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’ আমি কেন গ্রহণ করব না? আমি মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার থেকে শুরু করে অনেকের পুরস্কারই তো নিয়েছি। সমালোচনা হলে অন্য পুরস্কারগুলোরও সমালোচনা হওয়া উচিত। আর হুমায়ূনের প্রতি তো আমার অশ্রদ্ধা ছিল না। লোকে ভুল মনে করছে। তাঁর সঙ্গে আমার খুব প্রীতির সম্পর্ক ছিল। একবার নিউইয়র্কে গিয়ে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। হুমায়ূনও তখন আমেরিকায় ছিল। আমার অসুস্থতার খবর পেয়ে সে হসপিটালে আমার বিছানার পাশে বসে ছিল। বলছিল, ‘স্যার, আপনি অসুস্থ শুনে আমি দেখতে এসেছি।’ হুমায়ূন তো মানুষ হিসেবে খুব ভালো ছিল।
- Get link
- X
- Other Apps
Comments
Post a Comment